স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট কৃষি
ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ
বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের রূপকল্প ২০৪১ এর নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ মূলত চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর নির্মিত- (১) স্মার্ট সিটিজিন (২) স্মার্ট সরকার (৩) স্মার্ট অর্থনীতি ও (৪) স্মার্ট সমাজ। আর এই প্রতিটি বিষয়ই কোন না কোনভাবে কৃষির সাথে জড়িত। মানবসভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে কৃষির হাত ধরে। উন্নত বিশ্বে কৃষির যে যন্ত্রায়ন হয়েছে তাকে মূলত ৩য় প্রজন্মের কৃষি বা কৃষি ৩.০ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। বর্তমানে স্মার্ট কৃষির যে ধারণা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে কৃষি ৪.০।
আশির দশকে যখন প্রথম সবুজ বিল্পবের সূচনা হয়, তার হাত ধরেই খাদ্য উৎপাদনে এসেছে যুগান্তকারী উন্নতি। ক্রমাবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে তার প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু কৃষি ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশকে করেছে বিপদ সংকুল। এটা অনুমান করা হয় যে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭০ কোটিতে উন্নীত হবে। এই বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য আরো প্রায় ৭০% খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, যা বর্তমান কৃষি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। উপরন্তু বর্ধিত জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলছে আবাদি জমি যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নতুন আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই সমস্যা বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশকে সংকটময় অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য একই জমি বারবার ব্যবহার হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপরিমিত ব্যবহার জমিকে করে তুলছে বিষাক্ত। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। এই সকল কারণে মাটি, পানি, বাতাস হয়ে পড়ছে দূষিত, নেমে আসছে পরিবেশ বিপর্যয়। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশকে সমুন্নত রেখে নিরাপদ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কম খরচে বেশি খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণনের এক সমন্বিত প্রযুক্তির নামই কৃষি ৪.০ বা স্মার্ট কৃষি।
স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তি মূলে আছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন। দেশের প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা এখনো মূলত কৃষিনির্ভর, তাই স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না।
স্মার্ট কৃষির প্রধান অনুসঙ্গ ডিজিটাল প্রযুক্তি। কৃষি কর্মের সর্বক্ষেত্রে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিকল্পনা গ্রহণ, উন্নয়ন, বাস্তবায়ন ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করাই এর প্রধান কাজ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা কৃষি ৩.০ এর আরম্ভ মাত্র। আমরা চাইলেই কৃষি ৩.০ বাস্তবায়ন না করেও কৃষি ৪.০ এর গর্বিত অংশীদার হতে পারি। তার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যথোপযোক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কল্পে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রচেষ্টা সরকার গ্রহণ করেছে (যেমন- কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির উপর কর হ্রাস, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষকপর্যায়ে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি), তা যেন স্মার্ট কৃষির উপযুক্ত হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃতপক্ষে কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এককভাবে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তার জন্য কৃষিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, আইটি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, পরিবেশবিদ, রাজনীতিবিদ, কৃষি বিজ্ঞানী ও জনসাধারণের সম্মিলিত সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা কৃষি ৩.০ এর আরম্ভ মাত্র যা উন্নত বিশ্বে বিগত একশত বছর যাবৎ বাস্তবায়ন করেছে। তাই সকল ক্ষেত্রে স্মার্ট কৃষি আমাদের দেশে এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাতসমূহ নির্ধারণ করে ডিজিটাল প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই সাথে ব্যয়বহুল ডিজিটাল প্রযুক্তি সমৃদ্ধি কৃষি যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল তৈরির চেষ্টা করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আগামী বছরে দেশের মোট প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা নিরূপণ করবেন। সেই পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের দেশে কতটুকু জমি আছে এবং সেই জমি কোথায় এবং কার অধিকারে আছে তা জানা যাবে ভূমি ব্যবস্থাপনা তথ্য ভা-ার থেকে। এই ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। সেই সাথে মাঠপর্যায়ের জমির বর্তমান অবস্থা, যেমন: জমির প্রকৃতি, জমিতে কি পরিমাণ নাইটোজেন, পটাশিয়াম, ফসফেট ও অন্যান্য উপাদন আছে তা ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে জমিতে কোন ফসল ভাল জন্মাবে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি হবে তার একটি বাস্তব ধারণা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে পাওয়া যাবে। সেই সাথে কৃষিবিষয়ক যে কোন সমস্যার সমাধান, সম্ভাবনা, পরামর্শ যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে গ্রহণ করা যাবে।
মাঠ পর্যায়ে ব্যবহৃত স্মার্ট যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাক্টর, মনুষ্যবিহীন যান ড্রোন, স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ রোবট, মাটি ও ফসলের বর্তমান আস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকার সেন্সর ইত্যাদি। স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র ফসলের প্রয়োজন বুঝে পরিমিত সেচ প্রদান করে যাতে পানির অপচয় রোধ করার সাথে সাথে পানির ব্যবহার হ্রাস করে। মাটি পরীক্ষণ সেন্সর মাটিতে দ্রবীভূত নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফেটের পরিমাণ নির্ণয়, মাটির পিএইচ ও তাপমাত্রা এবং পানির পরিমাণ নির্ণয় করে হালনাগাদ তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভা-ারে প্রেরণ করে। প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্নেষণ করে জমিতে সারের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। ফলে জমিতে অযাচিত রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং মাটির গুণাগুণ অক্ষুণœ রাখার সাথে সাথে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট আগাছা চিনতে পারে এবং ধ্বংস করতে পারে কোন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার না করেই। মাঠের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোন খুবই কার্যকরি একটি যন্ত্র। ড্রোন ব্যবহার করে কোন এলাকায় কি ধরনের ফসলের আবাদ হয়েছে তা যেমন নির্ধারণ করা যায় তেমনি ফসল কোন ধরনে বালাই দ্বারা আক্রান্ত হলে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এতে ফসলে ক্ষতি হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হয়। একইভাবে ড্রোনের সাহায্যে জমিতে বীজ ছিটানো, সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কাজও করা যায়।
কৃষি জমির বর্তমান অবস্থা নিরূপণের জন্য সেন্সর যুক্ত বহনযোগ্য মাঠপর্যায়ে ব্যবহার উপযোগী যন্ত্র দেশে খুব কম খরচে তৈরি করা সম্ভব। কৃষিতে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন ও প্রয়োজনীয় সফটওয়ার বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার্থীরা সহজেই তৈরি করতে পারে। তাছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যৌথভাবে কাজ করে তাদের উৎপাদিত যন্ত্রপাতি স্মার্ট কৃষির উপযুক্ত করে নিতে পারে। এর ফলে, একাধারে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে তেমনি দেশীয় প্রযুক্তি বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখবে।
স্মার্ট কৃষি কেবলমাত্র কৃষি যন্ত্রপাতি নির্ভর নয়। স্মার্ট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রদান করে। এতে কৃষক সরাসরি ভোক্তাপর্যায়ে পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ফেলতে পারে। এতে কৃষক যেমন লাভবান হতে পারে তেমনি ভোক্তারাও স্বল্পমূলে সঠিক পণ্য ক্রয় করতে পারে। এই ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি নিরাপদ সমাধান হতে পারে।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে কৃষি রোবট হয়তো সঠিক সমাধান নয়। মাড়াই মৌসুমে শ্রমিকের অভাবে অনেক সময় বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয় এবং মাড়াইকাজে কৃষকের খরচ বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই মাড়াইকাজে কম্বাইন্ড হারভেস্টার এবং ধান রোপণের ক্ষেত্রে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের বহুল ব্যবহার প্রয়োজন।
যে কোন ডিজিটাল প্রযুক্তির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তথ্য ও উপাত্তের নিরাপত্তা। স্মার্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সকল বিষয়ে তথ্য ও উপাত্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা। স্মার্ট কৃষিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহারকারীরা এখন অনেকটাই সচেতন হয়ে উঠছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার দেশের তথ্যভা-ার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার লিমিটেড নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করেছে। যার মাধ্যমে স্মাট কৃষি প্রয়োজনীয় তথ্যের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে।
স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের চার স্তরের নেটওয়ার্কের প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন সেন্সর থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে। প্রথম স্তরের কাজ যা ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতিতে স্থাপিত হবে। ২য় স্তরে রয়েছে আমাদের নিত্যদিনে ব্যবহৃত স্মার্ট ফোন, ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, জিগবি, লোরা ইত্যাদি, যা দেশের সকল জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে বা খুব সহজেই স্থাপন করা যাবে। ২য় স্তরের মূল কাজই হলো প্রথম স্তরের তথ্য সংগ্রহ করে কোন কোন ক্ষেত্রে তার বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া। সেই সাথে সংগৃহীত তথ্য মূল তথ্যভা-ারে প্রেরণের জন্য তৃতীয় স্তরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। তৃতীয় স্তরের কাজ হচ্ছে মাঠপর্যায়ের সকল তথ্য মূল তথ্যভা-ারে পৌঁছে দেওয়া। তার জন্য মোবইল টাওয়ার, টেলিফোন নেটওর্য়াক, অপটিক্যাল ফাইবার ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে পারে, যা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যামান আছে। চতুর্থ বা শেষ স্তরে আছে মূল তথ্য ভা-ার। বাংলাদেশ ডাটাসেন্টার কোম্পানি লিমিটেড সংগৃহীত তথ্য প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
স্মার্ট কৃষির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সকল কৃষকের জন্য স্মার্ট প্রযুক্তি, বৃহৎ বা ক্ষুদ্র যাই হোক, যে কোন সময় যে কোন স্থানে ব্যবহার উপযোগী হওয়া। কাজেই একটি নিতিমালার আওতায় প্রয়োজনীয় সফটওয়ার তৈরি করে তথ্যের যথোপযুক্ত নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই স্মার্ট বাংলাদেশ যেমন বাস্তবায়িত হবে তেমনি স্মার্ট কৃষির সুফল সকলেই উপভোগ করতে পারবে।
লেখক : অধ্যাপক, তড়িত ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মোবাইল : ০১৭৩৪৩১১৫৯০ ই-মেইল : ahsan@cuet.ae.bd